ভারতীয় সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য (Salient features of Constitution of Independent India) :-
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি ভারতের সংবিধান বলবৎ হওয়ার দিন থেকে এই সংবিধান অনুযায়ী ভারত রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালিত হয়ে আসছে । পৃথিবীর অগ্রণী দেশসমূহের সংবিধানের ভালো দিকগুলি নিতে গিয়ে ভারতের সংবিধান নানা বৈশিষ্ট্যে মন্ডিত হয়েছে । ভারতীয় সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল :-
(১) বিশ্বের দীর্ঘতম ও জটিলতম সংবিধান [Largest and Rigid Constitution]:-
ভারতের সংবিধান হল পৃথিবীর দীর্ঘতম, লিখিত ও জটিল সংবিধান । ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি ভারতের সংবিধান কার্যকর হওয়ার সময় এই সংবিধানে মোট ৩৯৫ টি ধারা (Article) এবং ধারাগুলি ২২টি পার্টে ও ৮ টি তপশীল (Schedule) -এবিভক্ত ছিল । বর্তমানে এই সংবিধানে মোট ৪৪৮ টি ধারা (Article) আছে এবং ধারাগুলি ২২টি পার্টে ও ১২ টি তপশীল (Schedule) -এ বিভক্ত । বিশ্বের কোনো দেশের সংবিধানে এতগুলি ধারা এবং উপধারা নেই । ভারতীয় সংবিধানে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়ছে ।
(২) সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় [Flexible] :-
ভারতীয় সংবিধানের কতকগুলি ধারা আছে অনড় আবার সেই সঙ্গে কতকগুলি ধারা আছে পরিবর্তনীয় । প্রয়োজনে মাঝে মাঝেই সরকারকে সংবিধান সংশোধন করতে হয় । সংবিধানে প্রদত্ত নির্দেশ অনুযায়ীই এই সংবিধান সংশোধন করতে হয় । সংবিধানের কোনো ধারা পরিবর্তন করতে হলে আইনসভার উচ্চ কক্ষ ও নিম্নকক্ষের ২/৩ অংশ সদস্যের সম্মতিতে সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন এবং ৩/৪ অংশ সদস্যের দ্বারা তা গৃহীত না হলে সংবিধানের কোনো ধারার পরিবর্তন আনা যাবে না । সংবিধানের ৪২ তম সংশোধনে উল্লেখ করা হয়েছে যে সংবিধানের যে-কোনো অংশের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিবর্জনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে থাকবে । ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি ভারতের সংবিধান চালু হওয়ার পর থেকে ২ রা জানুয়ারি ২০১৩ পর্যন্ত ৯৮ বার সংবিধান সংশোধিত হয়েছে ।
(৩) যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো [Federal]:-
সংবিধানে ভারতবর্ষকে কোথাও যুক্তরাষ্ট্র বলে উল্লেখ করা হয় নি । ভারতবর্ষকে বলা হয়েছে রাজ্য সমূহের সমষ্টি বা রাজ্যসংঘ (Union of States) । যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামো অনুসারে কেন্দ্রে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যে রাজ্য সরকার গঠিত হয়েছে । ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার শীর্ষে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার । অঙ্গ রাজ্যগুলির শাসনভার সেখানকার নির্বাচিত সরকারের ওপর ন্যস্ত । ক্ষমতা বিভাজনের ক্ষেত্রে সংবিধানে তিনটি তালিকা আছে— (i) কেন্দ্রীয় তালিকা, (ii) রাজ্য তালিকা ও (iii) যুগ্ম তালিকা । কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলি কতকগুলি বিষয়ে স্বাধীনতা ভোগ করেন ও আইন প্রণয়ন করেন । প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়, মুদ্রা, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি ৯৭টি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে আছে । একে কেন্দ্রীয় তালিকা বলে । রাজ্যগুলির অভ্যান্তরীণ প্রশাসন, স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন প্রভৃতি মোট ৬৬ টি বিষয়ের ভার দেওয়া হয়েছে রাজ্যগুলির ওপর । একে রাজ্য তালিকা বলে । এছাড়া বিচারব্যবস্থা, সংবাদপত্র, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সেচ প্রভৃতি ৪৭টি বিষয়ে যুগপৎ কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলি আইন প্রণয়ন করতে পারে । একে যুগ্ম তালিকা বলে ।
(৪) নাগরিকের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি [Fundamental right]:- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অনুকরণে ভারতের নাগরিকগণ যাতে গণতান্ত্রিক অধিকার যথাযত রূপে ভোগ করতে পারেন সেজন্য ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের কতকগুলি মৌলিক অধিকার দান করা হয়েছে । সংবিধানের ১৪ নং থেকে ৩৫ নং ধারাতে নাগরিকদের উদ্দেশ্যে উল্লিখিত সাতটি মৌলিক অধিকারগুলি হল— (i) সাম্যের অধিকার, (ii) স্বাধীনতার অধিকার, (iii) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার, (iv) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, (v) শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে অধিকার, (vi) সম্পত্তির অধিকার (vii) সাংবিধানিক প্রতিকারের অধিকার । ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ৪৪তম সংবিধান সংশোধন করে 'সম্পত্তির অধিকার'কে মৌলিক অধিকারের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে । বর্তমানে ভারতের নাগরিকরা ছয়টি মৌলিক অধিকার ভোগ করে থাকেন । অবশ্য এই অধিকারগুলি নিরঙ্কুশ নয় । জরুরি অবস্থার সময় নাগরিকদের এই মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয় । মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে যে-কোনো ভারতীয় নাগরিক হাইকোর্ট বা সুপ্রিমকোর্টে আপীল করতে পারেন ।
(৫) নির্দেশমূলক নীতির সংযোজন [Directive Principle]:-
ভারতীয় সংবিধানে কতকগুলি নির্দেশমূলক নীতির সংযোজন করা হয়েছে । আয়ারল্যান্ডের সংবিধানের অনুকরণে গৃহীত রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতিগুলি সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । ভারতের সংবিধানে ৩৬ নং থেকে ৫১ নং ধারাগুলিতে এই নির্দেশমূলক নীতি গৃহীত হয়েছে । জনগণের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ সাধন করে ভারতবর্ষকে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করাই হল নির্দেশমূলক নীতির উদ্দেশ্য । বেকারভাতা, বার্ধক্যভাতা, স্ত্রী ও শিশুদের বিশেষ সুযোগদান, অবৈতনিক চিকিত্সা ইত্যাদি এই নীতির অন্তর্গত । মৌলিক অধিকারগুলির মতো এগুলি আইনে বলবৎযোগ্য না হলেও ৪২ তম সংবিধান সংশোধনে এই নীতি গুলির উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে । নির্দেশমূলক নীতিকে কোনভাবেই মৌলিক অধিকার বলে দাবি করা যায় না ।
(৬) সংসদীয় শাসনব্যবস্থা [Parliamentary System]:-
যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান হলেও ভারতীয় সংবিধানে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা নির্দিষ্ট আছে । ভারতের মন্ত্রিসভা পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকে নিযুক্ত হয় । লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রীসভাই প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী । রাষ্ট্রপতি হলেন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান । রাজ্যাগুলিতেও এই প্রথা চালু আছে ।
(৭) এক নাগরিকত্ব [Single CItizenship] :-
ভারতীয় শাসনতন্ত্রে ভারতবাসীর এক নাগরিকত্ব (Single Citizenship) স্বীকৃত হয়েছে । ভারতের অঙ্গ রাজ্যগুলিতে পৃথক নাগরিকত্বের ব্যবস্থা নেই । সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারত রাষ্ট্রকে একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে বর্ণনা করা হয়েছে । পরবর্তীকালে প্রস্তাবনার মূল বয়ানটি সংশোধন করে ভারতবর্ষকে সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে বর্ণনা করা হয়েছে । ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক রূপের সঙ্গে এর সমাজতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ রূপটি তুলে ধরতেই রাষ্ট্র নায়কগণ ১লা এপ্রিল ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীতে উক্ত শব্দদুটি সংযোজিত করেছেন ।
(৮) মৌলিক কর্তব্য [Fundamental Duties] :-
ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের ১০টি মৌলিক কর্তব্যের [Fundamental duties] উল্লেখ আছে । প্রতিটি নাগরিক এই কর্তব্যগুলি মেনে চলতে বাধ্য । এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সংবিধানের আদর্শ মান্য করা, দেশের সার্বভৌমত্ব, অখন্ডতা, সংহতি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদির প্রতি মর্যাদা প্রদান ।
(৯) ধর্ম নিরপেক্ষতা:-
সংবিধানে ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র (Secular State) হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে । কোনো বিশেষ ধর্মকে ভারতের রাষ্ট্রীয়ধর্ম (State Religion) হিসেবে স্বীকার করা হয়নি । ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী জাতি, ধর্ম ও ভাষার পার্থক্যের জন্য রাষ্ট্র কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না । প্রত্যেক নাগরিকই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম আচরণ করতে পারবে ।
(১০) এককেন্দ্রিকতা :-
ভারতীয় সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় হলেও দেশের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের হাতে আছে । দেশের ঐক্য ও সংহতি যাতে কোনো রূপেই বিঘ্নিত হতে না পারে তার জন্যই সংবিধান রচয়িতাগণ কেন্দ্রের হাতে অধিকতর ক্ষমতা অর্পণ করেছেন ।
(১১) দায়িত্বশীল সরকার:-
কেন্দ্রে একটি দায়িত্বশীল সরকার আছে । এই সরকারই প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী । সরকার তার যাবতীয় কাজের জন্য পার্লামেন্টের কাছে দায়বদ্ধ । পার্লামেন্ট মন্ত্রিসভার কাজের সমালোচনা করতে পারে । সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যবৃন্দের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ।
(১২) সার্বজনীন ভোটাধিকার :-
ভারতীয় সংবিধানে প্রথমে ২১ বত্সর বয়স্ক প্রত্যেক নাগরিককে ভোটাধিকার দেওয়া হয়েছিল । ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ৬২তম সংবিধান সংশোধনের দ্বারা ভোটদানের বয়সসীমা ২১ থেকে কমিয়ে ১৮ বত্সর করা হয়েছে । এক্ষেত্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা ধনী দরিদ্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয় না ।
(১৩) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা :-
ভারতের সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে । সুপ্রিমকোর্ট এবং রাজ্য হাইকোর্টগুলির বিচারকদের চাকরির নিরাপত্তা রক্ষিত হয়েছে । কোনো বিচারক একবার বিচারক পদে নিয়োজিত হলে শাসন বিভাগ কর্তৃক তাঁর বেতন ও ভাতা কমানো যায় না । বিচারকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ পার্লামেন্টের দুই তৃতীয়াংশের ভোটে গৃহীত হওয়া ছাড়া শাসনবিভাগ কোন মতেই তাঁকে পদচ্যুত করতে পারবে না । এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ভারতের বিচার বিভাগের একটি বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা আছে । শাসন বিভাগের প্রভাব থেকে বিচার বিভাগকে মুক্ত রাখার ব্যবস্থাও সংবিধানে করা হয়েছে । ইংল্যান্ডের গণতান্ত্রিক রীতি নীতি অনুযায়ী জনসাধারণ কর্তৃক প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক সরকার সমূহ নির্বাচিত হয় । নির্ধারিত সময়ের পূর্বে লোকসভায় কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিধানসভায় কোনো রাজ্য সরকার পরাজিত হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয় । তখন তার জায়গায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা গোষ্ঠীর মধ্যে থেকে নতুন সরকার গঠিত হয় । কোনো দল বা গোষ্ঠী সরকার গঠনে অক্ষম হলে নতুন করে জনগণের রায় নেবার প্রয়োজন হয়, অর্থাৎ নতুন করে কেন্দ্রে অথবা রাজ্যে অন্তর্বর্তী নির্বাচনঅনুষ্ঠিত হয় ।