(১)দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ
মাস্কবাদের অন্যতম সূত্র হল দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। বস্তুবাদী মাস্কের মতে, পৃথিবী বস্তুময়, বস্তুই প্রধান। তাঁর মতে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কে পরিবর্তনের জন্যই সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তিত হয়।মাস্কের বস্তুবাদ হেগেলের ভাববাদের মত দ্বন্দ্বমূলক। মাস্ক হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক ভাববাদ কে দণ্ডমূলক বস্তুবাদে পরিণত করেছে।
ব্যাখ্যা→ মাস্কের মতে, বস্তুর মধ্যেয় বিরোধের বীজ লুকিয়ে আছে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এই কথায় বিশ্বাস করে যে প্রতিটি বস্তু ও ঘটনার মধ্যে পরস্পর বিরোধী ধর্ম বিদ্যমান। পুজিবাদী সমাজে পুজিপতি শ্রেণীর সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব বা বিরোধ এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এই দ্বন্দের মধ্যে তিনটি বিষয় কাজ করে,সেগুলি হলো- বাদ, প্রতিবাদ, সম্বাদ
বাদ, প্রতিবাদ, সম্বাদ→ যখন শ্রমিক ও মালিক উভয়ের সম্পর্ক ভালো থাকে সেই পর্যায়কে বাদ বলে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই উভয়ের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়, এই অবস্থাকে বলে প্রতিবাদ। তারপর উভয়ের মধ্যে সংঘাতের ফলে উন্নত যে সমাজ ব্যবস্থা উদ্ভব হয়, তাকে বলে সম্বাদ। এইভাবে পুরাতন সমাজের পরিবর্তে নতুন সমাজের উদ্ভব হয়।
মূল্যায়ন→দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের স্রষ্টা কে তা নিয়ে মতবিরোধ আছে। অনেকের মতে ইঙ্গেলসই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ তত্ত্বের অবতারণা করেন। বক্তব্যের মধ্যে কিছুটা সত্যতা থাকলেও, মাস্ক তত্ত্বের ডেভিড রিকাড প্রমূখ অর্থনীতিবিদদের প্রভাব যেমন ছিল, তেমনই কাল্পনিক সমাজতান্ত্রিক দের প্রভাব কেও উপেক্ষা করা যায়না।
(২) সংগ্রামের তত্ত্ব
কালমাস্ক ও ইঙ্গেলস তাদের বিখ্যাত রচনা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্ট তে প্রথম বাক্য- "এ পর্যন্ত যত সমাজব্যবস্থা দেখা গেছে সেগুলির ইতিহাস শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। এর অর্থ কোন সমাজের ইতিহাসকে জানতে হলে শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাসকে জানতে হবে। শ্রেণিসংগ্রামি সমাজের চালিকাশক্তি। শ্রেণিসংগ্রাম তিন ধরনের। যথা- অর্থনৈতিক শ্রেণিসংগ্রাম, রাজনৈতিক শ্রেণীসংগ্রাম এবং আদর্শগত শ্রেণিসংগ্রাম। উৎপাদন কে কেন্দ্র করে সমাজের দুটি শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। এই দ্বন্দ্ব পরিণতি লাভ করে বাদ, প্রতিবাদ ও সম্বাদ এর মধ্য দিয়ে। শ্রমিক বুঝতে পেরে যে একমাত্র শাসক শ্রেণীকে উৎক্ষাতের মাধ্যমেই নতুন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
শ্রমিক শ্রেণীর এক নায়কত্ব→ শ্রেণি সংগ্রামের চরম প্রকাশিত হলো বিপ্লব। বৈপ্লবিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে শাসক শ্রেণী হিসেবে শ্রমিক শ্রেণী নিজেকে একদিন প্রতিষ্ঠিয করবে। তারপর একদিন শ্রমিকশ্রেণী উৎপাদনের ওপর ব্যাক্তি মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করবে। শ্রেণীহীন, শোষণহীন, সাম্যবাদী সমাজ গঠনের দিকে অগ্রসর হবে এইভাবে মাস্ক দেখিয়েছেন যে শ্রেণি সংগ্রাম কে অবলম্বন করে শ্রমিক কৃষক মেহনতি শ্রেণী মানব জাতিকে শ্রেণী শোষণ থেকে মুক্ত করবে।
মূল্যায়ন→ পশ্চিমি তাত্বিকরা বলেছেন যে সমাজ জীবনে দ্বন্দ্বের একমাত্র উৎস শ্রেণী স্বার্থের সংঘাত নয়।মাস্ক শ্রেণী সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেননি। ধনতান্ত্রিক সমাজেও মানুষের জীবনযাত্রা মান উন্নত হয়েছে। রাষ্ট্রসবসময় শ্রেণী শোষণের যন্ত্র নয়। জনকল্যাণ কর রাষ্ট্র সবসময় শ্রেণী শোষণের যন্ত্র নয়। জনকল্যাণ কর রাষ্ট্র জনগণের অনেক কল্যাণ করেছে।
(৩) ঐতিহাসিক বস্তুবাদ
মাস্কবাদের অন্যতম নীতি হলো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। ডারউইন যেমন জীব-জগৎ এর বিবর্তনের সূত্র আবিষ্কার করেছেন, মাস্ক ও তেমনি মানব ইতিহাসের বিকাশের সূত্র আবিষ্কার করেছেন। মানুষের বিকাশ এবং মানুষ্য সমাজ ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিকাশের ইতিহাসে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়োগ কেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলা হয়। মানব সমাজ বস্তুজগৎ এর অঙ্গ। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল আলোচ্য বিষয় হল সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশের ইতিহাস আলোচনা করা।
ব্যাখ্যা→ মাস্ক মানব ইতিহাস পর্যালোচনা করে প্রমাণ করেছেন যে, মানুষের প্রয়োজনীয় উৎপাদন এবং উৎপাদন পদ্ধতির প্রভাবে মানুষ্য সমাজের মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সুতরাং মাস্কের মতে, উৎপাদন পদ্ধতি হল সব কিছুর মূল। একে কেন্দ্র করে অর্থনীতি আবর্তিত হয়। এর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে শ্রেণী সম্পর্ক এবং সমাজ। উৎপাদনের প্রতিটি স্থরেই শ্রেণী দ্বন্দ্ব এবং এই দ্বন্দের মধ্যে দিয়ে সমাজের অগ্রগতি সাধিত হয়। মাস্ক বলেছেন, প্রতিটি পুরাতন সমাজের মধ্যেয় নতুন সমাজের উদ্ভবের প্রকৃয়া শুরু হয় আর তখন শক্তি ধার্তি হিসেবে কাজ করে। এভাবে সমাজের বিকাশিত ও পরিবর্তিত হয়। মাস্ক তার ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সাহায্যে বৈজ্ঞানিক উপায়ে সমাজ বিবর্তনের ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন।
মূল্যায়ন→পশ্চিমি তাত্বিক গণ বস্তুবাদ তত্ত্ব টিকে বিভিন্ন দিক থেকে আলোচনা করেছেন। তাদের মতে মাস্ক, এঙ্গেলস একটি মাত্র কারণের সাহায্যে ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। দ্বিতীয় অভিযোগটি হলো এই তত্বটি 'ঐতিহাসিক নিয়তিবাদ' যার অর্থ ইতিহাসের অমোখ নিয়মে সবকিছু নির্ধারিত হচ্ছে, মানুষের কিছু করা নেই। অর্থাৎ ইতিহাস ঈশ্বরের জায়গা নিয়েছে। মানুষের হয়ে গেছে ইতিহাসের নিয়মে হাতের কৃড়নক। এই আলোচনা গুলি যথার্থ নয়। কারণ সমাজের কর্ম বিকাশের ধারাকে বিশ্লেষণ করলে একথা প্রতীয়মান হয় যে, ইতিহাসের সব ঘটনার পশ্চাতে কোন না কোনভাবে অর্থনীতির প্রভাব বিস্তার করে।